যশোরে বসতঘরে বোমা বিস্ফোরণে খাদিজা নামে এক শিশু নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে তার আরও দুই ভাইবোন। হৃদয়বিদারক এ ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে এলাকায়। এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।প্রশ্ন উঠেছে বসতঘরের ভেতরে বোমা এলো কিভাবে? যদিও পরিবারের দাবি, কুড়িয়ে পাওয়া বোমা ঘরে নিয়ে খেলতে গিয়ে শিশুরা হতাহত হয়েছে। অপরাধে হটস্পট হিসেবে পরিচিত শংকরপুরে বোমা বিস্ফোরণের বিষয়টি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতার জন্য রাখা ছিল, সেটি খতিয়ে দেখছে প্রশাসন।
সোমবার সকাল ৮টার দিকে শহরের শংকরপুর জমাদ্দারপাড়া এলাকার বস্তির একটি বসতঘরে বোমা বিস্ফোরণে খাদিজা (৭) নিহত হয়। আহত হয় তার দুই ভাই-বোন সজীব (৫) ও আয়েশা (৩)।
খাদিজা ও সজীব ওই এলাকার শহিদুল ইসলাম সুজন-সুমি খাতুন দম্পতির সন্তান। শহিদুল আত্মহত্যা করলে তার স্ত্রী সুমিকে বিয়ে করেন ছোট ভাই শাহাদত গাজী। তাদের সন্তান আয়েশা খাতুন।
এ বিষয়ে কোতয়ালি থানার ওসি আবুল হাসনাত বলেন, ঢাকায় নেওয়ার পথে শিশু খাদিজার মৃত্যু হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পেয়েছি শিশুরা ককটেলসদৃশ বোমা বাইরে থেকে কুড়িয়ে ঘরে এনেছিল। খেলতে গিয়ে বিস্ফোরণে তারা আহত হয়েছে।
জানা যায়, শহরের শংকরপুর জমাদ্দারপাড়ার আধপাকা টিনের বাড়িতে তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন শাহাদত ও সুমি দম্পতি। কখনো হকারি, কখনো বাদাম বিক্রি করে সংসার চালান তারা। প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালে তিন সন্তানকে বাড়িতে রেখে কাজের সন্তানে বের হন তারা। ঘরের ভেতর প্যাকেটে খেলনার বলসদৃশ বস্তু হাতে নিয়ে খেলা শুরু করে তাদের বড় মেয়ে খাদিজা (৭)। এ সময় হঠাৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রক্তাক্ত অবস্থায় খাদিজা ও সজীবকে দ্রুত উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়রা। অবস্থা গুরুতর হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে খাদিজার মৃত্যু হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছে আয়েশা।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ডাক্তার ইমন হোসেন জানিয়েছেন, আহত তিনজনের মধ্যে খাদিজা ও সজীবের শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকায় রেফার করা হয়।
এদিকে মাদকের হটস্পট হিসেবে পরিচিত শংকরপুরে বোমা বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। কিভাবে ঘরের ভেতরে বোমাটি পাওয়া গেছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানায়, নিহত শিশু খাদিজার বাবা শহিদুল ইসলাম সুজন মারা যাওয়ার পর ছোট ভাই শাহাদতের সঙ্গে ওই শিশুর মায়ের বিয়ে হয়। শাহাদত রিকশা চালায় ও মাদকাসক্ত। স্থানীয় সন্ত্রাসী মুসার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন শাহাদত। তাদের দাবি, শাহাদত ওই বোমা গোপনে ঘরের মধ্যে রেখেছিল। যদিও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে পুলিশ।
শিশুর দাদি মনোয়ারা বেগম জানান, আমরা সকালে উঠানে বসে খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘরের ভেতরে বিকট শব্দ শুনি। তাকিয়ে দেখি ধোঁয়া বের হচ্ছে। ঘরে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় ওরা পড়ে আছে। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে এনেছি।
নিহতের মা সুমি খাতুন বলেন, বাড়ির সামনে খেলার মাঠে কলাগাছের গোড়াতে কেউ বোমা রেখেছিল। সেটা সকালে তারা কুড়িয়ে পেয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। সকালে বের হওয়ার সময় দেখি তাদের হাতে লাল টেপ দিয়ে পেঁচানো বলের মতো কিছু একটা নিয়ে খেলা করছে। আমি দেখে বুঝেছিলাম, বল নিয়ে তারা খেলা করছে। পরে শুনি আমরা সন্তানেরা বোমার আঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কিভাবে ঘরের ভিতরে এই বোমা এসেছে, সেটা বুঝতে পারছি না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, আমার নাড়িছেঁড়া ধন এভাবে প্রাণে হারাবে, সেটা কখনো বুঝতে পারেনি। এক মেয়েরে তো হারালাম, আরেক সন্তান মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আগে যদি জানতাম, ওদের হাতে বোমা, তাহলে কি আর খেলা করতে দিতাম। কারা আমার এ সর্বনাশটা করল।
দুপুরে শিশুটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী বাড়িসহ এই এলাকা ঘিরে রেখেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় রয়েছে ঘরের ভেতরের মেঝে। দূরদূরান্ত থেকে উৎসুক জনতা ভিড় করছেন শিশুদের বাড়িতে।
এদিকে খবর পেয়ে বেলা ১১টার দিকে যশোরের পুলিশ সুপার রওনক জাহানসহ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে দুপুর ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন সেনাবাহিনীর বোম ডিসপোজাল টিম। তারা বিস্ফোরণ হওয়া ঘর ও বাড়ির সামনের খেলার মাঠ পর্যবেক্ষণ করেন। দেড় ঘণ্টা বোম ডিসপোজাল টিম বোমাসদৃশ না পেয়ে কার্যক্রম শেষ করেন।
ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর যশোর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের বোম ডিসপোজাল টিমের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রিফাত জানান, আমরা শিশুটির ঘরে তল্লাশি করেছি। সেখানে টিনের কৌটা, লাল টেপসদৃশ ও কাঁচ পাওয়া গেছে। এরপর আমরা স্থানীয়দের কথা মতো বাড়ির সামনে খেলার মাঠে তল্লাশি করি। সেখানে কিছু পাইনি।
তিনি বলেন, বোমাটি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা। দুর্বৃত্তরা কোথাও নাশকতা ঘটনার জন্য এটি ব্যবহার করার জন্য রেখেছিল।
কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি (তদন্ত) কাজী বাবুল হোসেন, কিভাবে ককটেল এখানে রাখা হচ্ছে- সেটা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। এ ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।