শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত জ্ঞান, মানবিকতা ও মর্যাদার পীঠস্থান। কিন্তু শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক ঘটনায় সেই ধারণা একেবারে ভেঙে পড়েছে। উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে এইচএসসি মূল সনদ উত্তোলনের জন্য এক শিক্ষার্থী যখন কলেজে যান, তখন তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছে, তা শুধু দুঃখজনক নয়—তা লজ্জাজনকও।
অভিযোগ উঠেছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ.বি.এম মোখলেছুর রহমান (ID: ৯৬৮৩, বিসিএস ব্যাচ‑১৬) শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ‘স্টুপিড’ বলে গালি দিয়েছেন, ‘তুই’ সম্বোধনে অপমান করেছেন এবং পুরো প্রক্রিয়াকে করে তুলেছেন বিভ্রান্তিকর ও অসম্মানজনক।
একজন শিক্ষার্থী সিলেট শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষানিয়ন্ত্রকের বরাবর আবেদনপত্র নিয়ে কলেজে যান কেবল একটি স্বাক্ষর ও সিলমোহরের জন্য। অথচ কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা প্রথমেই তাকে জানিয়ে দেন, এই ফরম গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর হাতে থাকা আবেদনপত্রটি ছিল বোর্ড-স্বীকৃত, মার্জিত ও প্রফেশনাল, অথচ কলেজের পক্ষ থেকে বলা হলো এটি বাতিল।
বাস্তবতা হলো—মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে এই একই ফরম গ্রহণ করে শিক্ষার্থীর আবেদন সম্পন্ন হয়েছে। এটি থেকেই বোঝা যায়, নিয়ম নয়, ব্যক্তিগত অভিরুচিই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মূল নিয়ামক।
কেবল ফরমের অজুহাতেই শেষ হয়নি হয়রানি। অফিস সহকারী প্রথমে বলেন ফরম পরিবর্তন করতে হবে, পরে ফরম সরবরাহকারী বলেন, তিনি এখন ব্যস্ত, নতুন ফরম দিতে পারবেন না। বিকল্প হিসেবে বলা হলো কারো ফরমের ছবি তুলে কপি নিয়ে যেতে।
পরবর্তীতে জানানো হয়, আবেদন করতে হলে সঙ্গে একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টের দুই কপি লাগবে, যা শুরুতেই বলা হয়নি। আবেদনপত্রে স্পষ্টভাবে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর থাকার পরও এ দাবি করা হয়। পরের ধাপে বলা হলো—জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) ফটোকপিও দিতে হবে। অথচ জেলার অন্যান্য কলেজে এই ধরনের কোনো অতিরিক্ত কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় না। এ যেন ধাপে ধাপে এক পরিকল্পিত হয়রানি।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো—শিক্ষার্থীকে সকাল ১০টায় কলেজে পৌঁছেও বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে কেবল অধ্যক্ষের একটি স্বাক্ষরের জন্য। অপেক্ষারতদের মধ্যে ছিলেন এক ছাত্রী যিনি কোলে ছয় মাসের শিশু সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘ সময়। শিশুটি কান্না করছিল, ক্লান্ত ছিল, কিন্তু প্রশাসনের কারও তাতে কোনো কর্ণপাত ছিল না। এই মানবিক দুরবস্থায় কলেজ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এক ভয়াবহ প্রশ্ন তোলে।
অধ্যক্ষের ‘ব্যস্ততা’ যেন এখানে এক নাটকের অংশ। মিটিং শেষ হয় ২:৩০ মিনিটে, তখন তিনি ‘পরীক্ষার হল পরিদর্শন’-এর অজুহাতে শিক্ষার্থীদের রেখে চলে যান। ফিরে এসে আরও এক ঘণ্টা নিজের কক্ষে বসে থেকে ব্যক্তিগত কাজ দেখেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ডাকেন না। যখন শিক্ষার্থীরা অবশেষে কক্ষে ঢোকার অনুমতি পান, তখন শুরু হয় আরেক দফা অপমান।
ফরমে শিক্ষার্থীর নাম এক জায়গায় পুরোপুরি লেখা, অন্য জায়গায় কেবল স্বাক্ষর—এ নিয়েও প্রশ্ন তোলে অধ্যক্ষ। এরপর তিনি বলেন, “স্টুপিড কোথাকার!”—একজন অধ্যক্ষের মুখে এমন ভাষা কেবল অশোভন নয়, এটি শিক্ষার মূল নীতিমালার বিরুদ্ধাচরণ। এখানেই শেষ নয়—রংপুর থেকে আগত এক শিক্ষার্থীকে অধ্যক্ষ বলেন, “তুই রংপুর থেকে ভর্তি হইলি কেন?” এমন ‘তুই-তোকারি’ ভাষা একজন শিক্ষক বা প্রশাসকের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এই ঘটনার তুলনা চলে প্রশাসনিক শক্তির অপব্যবহারের সঙ্গে—যেখানে এককথায় বলা যায়, এটি এক “power trip”। পাশের কলেজে যেখানে সহানুভূতিশীল ব্যবহার ও কার্যকর সেবার মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার সনদ পায়, সেখানে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে চলছে লালফিতার দৌরাত্ম্য, ব্যস্ততার অজুহাত আর অপমানের সংস্কৃতি।
শিক্ষার্থীরা এই অবমাননার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ তুলেছেন, তা সময়োচিত এবং যৌক্তিক। তাঁরা দাবি তুলেছেন: আবেদন ও সনদ উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের তালিকা সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা একবারেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসতে পারেন।
কলেজে একটি “স্টুডেন্ট হেল্প ডেস্ক” চালু করতে হবে, যেখানে নির্দিষ্ট সময় ও ব্যক্তির মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত। আবেদন, ফরম, স্বাক্ষরসহ প্রতিটি ধাপ মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে এবং প্রতিবছর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।
সব শিক্ষকের জন্য ‘মানবিক প্রশিক্ষণ’ চালু করতে হবে, যেখানে সম্মানজনক ভাষা ব্যবহার ও আচরণের ওপর জোর দেওয়া হবে। শিক্ষা কেবল সনদ নয়, এটি মূল্যবোধ, মর্যাদা ও মানবিকতার চর্চা। আজ শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীকে ঘিরে যে ঘটনার জন্ম হয়েছে, তা আমাদের ভাবিয়ে তোলে—এই অবক্ষয়ের মুখে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোন বার্তা দিচ্ছি? আমরা চাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্মান ফিরুক, মানবিকতা ফিরে আসুক। শিলমোহরের চেয়ে বড় হয়ে উঠুক শিক্ষকের চরিত্র, শিক্ষার্থীর মর্যাদা। এখন সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল, মানবিক ও স্বচ্ছ করে তোলার। আর তা শুরু হোক—এই ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ দিয়ে।