দেশের প্রতিটি জেলার প্রত্যন্ত কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে জেলা সদর পর্যন্ত—এক অবাঞ্ছিত ছায়া নেমে এসেছে। নামী ‘পত্রিকা’ আর ‘নিউজ পোর্টাল’—যেগুলো সরকারের কোনো নথি নেই, কোনো ঘোষণাপত্র নেই—তবু গলায় আইডি ঝুলিয়ে, হাতে ক্যামেরা, মুখে ‘সাংবাদিক’দের জোড়ালো অভিনয়ে তারা ঘুরে বেঘেড়ে বেড়ায়।
এই ভুয়া সাংবাদিকরা কেবল খবর বানায় না; বাজারে ভয় ছড়ায়, ব্যবসায়ীকে চাঁদা দাবি করে, প্রশাসনিক কর্মীদের উপর বল প্রয়োগ করে — আর সত্যের কাঠামোকে ভেঙে ফেলে।
আইনের ভাষায় বিষয়টি পরিষ্কার: প্রেস ও প্রকাশনা অধ্যাদেশ, ১৯৭৩ বলেছেন—কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার আগে জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা ঘোষণাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। যা নেই, সেটি অবৈধ; অবৈধভাবে পরিচালিত পত্রিকাকে আইনি টার্গেটে আনা যায়। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম—অনেক জেলা এখন অনিবন্ধিত পত্রিকার দৌলতে প্রভাবস্বত্ব ও অর্থলোলুপতার শিকার।
এই অপসাংবাদিকদের ব্যবসা কেবল পাথেয় নয়; এটি একটি সামাজিক রোগ। তারা সংবাদ নয়, কু-সংবাদ তৈরি করে। তারা বানায় বিভ্রান্তি, ছড়ায় গুজব, আর ঠেলে দেয় সাধারণ মানুষকে অনিশ্চয়তার কালে। প্রকৃত সাংবাদিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করে তথ্য যাচাই করে, ঝুঁকি নিয়ে সত্য বলার চেষ্টা করেন—তাদের এঁটসেঁটিকেই কলঙ্কিত করছে এই ভুয়া চামচাকাররা।
আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ইতোমধ্যেই আইন আছে, প্রয়োগের অভাব আছে। জেলা প্রশাসক হলেন সেই প্রথম ধাপের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যিনি ঘোষণাপত্র মঞ্জুর কিংবা বাতিল করার যোগ্যতা রাখেন। ফলে অনিবন্ধিত পত্রিকা ও তাদের পরিচিত ভুয়া সাংবাদিকদের রুখতে ডিসি-দের সক্রিয় হওয়াই সময়ের দাবি। তথ্য অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও স্থানীয় প্রেস ক্লাব একজোট না হলে এই ভয়াবহতা রোধ করা যাবে না।
প্রশাসন যদি এখনই কঠোর না হয়, তবে আগামীকাল সাংবাদিকতা হবে একটি ব্যবসা—টাকা দিয়ে আইডি, টাকা দিয়ে ‘নিউজ’, টাকা দিয়ে প্রভাব। একদিন সেই বাজারে প্রকৃত সাংবাদিকরাই হারিয়ে যাবে; কারণ সত্য কথার কোনো দাম থাকবে না—শুধু গলনীর দাম থাকবে। তাই জেলা পর্যায়ে তৎপরতা নেওয়া বাধ্যতামূলক: অনিবন্ধিত মুদ্রণ/প্রকাশস্থল বন্ধ, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা, এবং সরকারি নথি যাচাই করে তালিকা প্রকাশ—এসবই হবে প্রথম ধাপ।
সংবাদমহল ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো এখুনি দাবি তুলছে—“অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স”। দাবি করা হচ্ছে প্রতিটি জেলার অফিসে অনিবন্ধিত পত্রিকার চেকিং, আইডি যাচাইবাছাই, এবং উল্লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও দণ্ডবিধিগত ব্যবস্থা গ্রহণ। শুধু দাবি নয়—চলমান নানা অভিযোগের ফাইল কর্তৃপক্ষের সামনে পেশ করা সময়ের দাবি করে; যাতে জেলা প্রশাসক সরাসরি কণ্ঠ উচ্চারণ করে—“আমার জেলায় অনিবন্ধিত পত্রিকা চলবে না। যারা ভুয়া সাংবাদিকতা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা হবে।”
অপসাংবাদিকতা চিরকালকার মতো নয়—এটি প্রতিহত করা যায়। প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, প্রশাসনিক সততা ও সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ। যদি এসব না করা হয়, তাহলে সংবাদক্ষেত্রের মর্যাদা ধ্বংসের যেন ঠিক আগে দাড়িয়েছি। আর সেটা হতে দিলেই চলবে না—পক্ষান্তরে, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সরকারেরই মংগলের জন্য উপকারী হবে।
দেশ আজ সতর্ক। অবৈধ পত্রিকা আর ভুয়া সাংবাদিকতার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে প্রশাসনকে সরাসরি নামতে হবে — না হলে গণমাধ্যমের আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হবে।