গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত গণমাধ্যম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একাধারে একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করার যে গুরুদায়িত্ব সাংবাদিকতার ওপর ন্যস্ত, তা আজ নানা প্রতিকূলতার বেড়াজালে আবদ্ধ।
বিশেষ করে, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের পেশাগত সংকট, সাংবাদিকতার নামে গজিয়ে ওঠা অপচর্চা এবং লাগামহীন রাজনৈতিক প্রভাব পুরো গণমাধ্যম জগতকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এর স্বরূপ বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।
তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যের প্রধান উৎস জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা বহুমুখী ঘাটতির শিকার। তাদের সিংহভাগের সাংবাদিকতার ওপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না থাকায় সংবাদ লিখন, সম্পাদনা এবং সাংবাদিকতার নীতিমালা ও আইনকানুন সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত।
এর সাথে যুক্ত হয় তীব্র আর্থিক অসচ্ছলতা ও পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নামমাত্র সম্মানী পান বা একেবারেই পান না, যা তাদের জীবিকার জন্য অন্য পেশার ওপর নির্ভরশীল করে তোলে এবং সাংবাদিকতায় পূর্ণ মনোযোগ ব্যাহত করে।
আধুনিক সরঞ্জামের অভাব এবং স্থানীয় প্রভাবশালী, প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হুমকি, মামলা ও শারীরিক আক্রমণের ভয় তাদের কাজকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এবং মূল গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের আয়োজন, স্থানীয় পর্যায়ে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করে ন্যায্য বেতন কাঠামো নিশ্চিতকরণ এবং সাংবাদিকদের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা প্রদান করা আশু প্রয়োজন।
সাংবাদিকতার এই কাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে অপসাংবাদিকতা বা হলুদ সাংবাদিকতা, যা পুরো পেশার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় চিড় ধরাচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং, কোনো তথ্য যাচাই ছাড়াই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চরিত্রহননের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে।
বিশেষ করে, নামসর্বস্ব ভূঁইফোড় অনলাইন পোর্টালগুলো এই অপচর্চার প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাধি রুখতে হলে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। চাঁদাবাজির মতো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে শক্তিশালী ফ্যাক্ট-চেকিং সেল গঠন এবং অপসাংবাদিকদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করার জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা আবশ্যক।
সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষা ও পেশাগত মানোন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত প্রেসক্লাবগুলোও এই অবক্ষয় থেকে মুক্ত নয়। অনেক স্থানীয় প্রেসক্লাবই এখন দলীয় রাজনীতি, দলাদলি ও বিভাজনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যা সাংবাদিকদের ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
আদর্শিকভাবে, প্রেসক্লাবগুলোকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিচালনা করা উচিত, যেখানে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত থাকবে এবং মূল উদ্দেশ্য হবে সদস্যদের পেশাগত উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা। বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সকল সাংবাদিকের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমেই প্রেসক্লাব তার প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তীব্র রাজনৈতিক প্রভাব। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF)-এর বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাগত নিম্নগামী অবস্থান এই বাস্তবতারই প্রতিফলন। সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সংগঠনগুলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আদলে বিভক্ত, যা তাদের সম্মিলিত দর-কষাকষির ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (DSA) মতো নিবর্তনমূলক আইনের কারণে তৈরি হওয়া সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি, যা অনুসন্ধানী ও সমালোচনামূলক সাংবাদিকতাকে প্রায় রুদ্ধ করে দিয়েছে।
এর দায়ভার কোনো একক পক্ষের নয়, বরং একটি সম্মিলিত ব্যর্থতার ফল। সরকার ও রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম মালিক, সাংবাদিক সংগঠন এবং ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধাভোগী সাংবাদিক—সকলেই এর জন্য কমবেশি দায়ী। এই অচলায়তন ভাঙতে হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইন বাতিল বা সংশোধন, দলীয় বিভাজন ভুলে সাংবাদিকদের পেশাগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণমাধ্যম মালিকদের সম্পাদকীয় নীতিতে হস্তক্ষেপ না করার নৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
এই ক্রান্তিকালে একটি গণমাধ্যমের ‘গেটকিপার’ বা দ্বাররক্ষী হিসেবে সম্পাদকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো চাপ বা প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পাদকীয় নীতিতে অটল থাকা, প্রতিটি সংবাদ প্রকাশের পূর্বে এর সত্যতা কঠোরভাবে যাচাই করার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং সত্য প্রকাশের কারণে কোনো সাংবাদিক বিপদে পড়লে তাকে সর্বাত্মক সুরক্ষা দেওয়া সম্পাদকের প্রধান দায়িত্ব।
এই নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে অগণিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের যুগে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্প্রতি পোর্টালগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নীতিগতভাবে ইতিবাচক হলেও এর প্রয়োগ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। অনেক মানহীন ও নামসর্বস্ব পোর্টাল অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নিবন্ধন পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
এই সমস্যার সমাধানে, নিবন্ধনের জন্য গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা উচিত। সুস্পষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে স্বচ্ছ ও অনলাইনভিত্তিক প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন প্রদান এবং পরবর্তীতে নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে শর্ত ভঙ্গকারী পোর্টালের নিবন্ধন বাতিলের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।
পরিশেষে, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা একটি বহুমাত্রিক সংকটকাল অতিক্রম করছে। এখান থেকে উত্তরণের পথ একক নয়, বরং সমন্বিত। সরকার, গণমাধ্যম মালিক, সাংবাদিক সমাজ এবং পাঠক—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা ও কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অপসাংবাদিকতার মূলোৎপাটন করে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও নৈতিক গণমাধ্যম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলেই তা একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ বিনির্মাণের পথকে সুগম করবে।
আলী মোহাম্মদ মঞ্জুর, লেখক ও সাংবাদিক।