কুরবান আরবি শব্দ। তার ফার্সি ও উর্দু শব্দ হল কুরবানি। তার অর্থ হল : নৈকট্য লাভ করা, প্রিয়ভাজন হওয়া।
পরিভাষায়, শরহে বেকায়াহ গ্রন্তপ্রণেতার মতে, কুরবানির দিনের যেকোন একটি দিনে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট প্রাণী জবাই করাকে কুরবানি বলে।
কুরবানির ইতিহাস : মহান আল্লাহ অতিতে বিভিন্ন জাতির জন্য কুরবানির বিধান করে দিয়েছিলেন। তবে তার পদ্ধতি ক্ষেত্র বিশেষ বিভিন্ন ধরনের ছিল।
মহান আল্লাহ বলেন, যুগে যুগে প্রত্যেক জাতির জন্যই কুরবানির বিধান ছিল। ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির বিধান করে দিয়েছি। তিনি জীবনোপকরণের জন্য যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে’ (সূরা হজ, আয়াত-৩৪)।
কুরবানির গোড়াপত্তন হয় হযরত আদম আ. দুপুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনার মাধ্যমে। কুরআনে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, হে রাসুল আপনি তাদের কাছে আদমের দুই পুত্রের সংবাদ পাঠ করে, সত্যতার সঙ্গে শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করল একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল, কিন্তু অন্যজনের হয়নি। এক ভাই বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব, অন্য ভাই বলল, আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের পক্ষ থেকে কোরবানি কবুল করেন। (সুরা আল মায়িদা, আয়াত : ২৭)
আমরা সুরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতের তাফসির ও সংশ্লিষ্ট ঘটনা পড়লে বুঝতে পারব, ইতিহাসের প্রথম কোরবানির সঠিক ও বিস্তারিত বিষয় : আদম (আ.)-এর দুপুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদসহ বর্ণিত হয়েছে, ঘটনার বিবরণ হলো যখন হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হয় তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। তখন ভ্রাতা ও ভগিনী ছাড়া আদমের আর কোনো সন্তান ছিল না। অথচ ভ্রাতা ও ভগিনী পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লাহতায়ালা বাস্তব প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.)-এর শরিয়তে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর সহোদর ভ্রাতা ও ভগিনী গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ব থেকে জন্মগ্রহণকারিনী কন্যা সহোদর ভ্রাতা ভগিনী হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।
ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ছিল সুন্দরী, আর হাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ছিল কুশ্রী, যা কাবিলের ভাগ্যে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রুতে পরিণত হলো। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে, হজরত আদম (আ.) তার শরিয়তের বিধান ঠিক রাখার জন্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর তিনি কাবিল-হাবিলের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বললেন তোমরা উভয়ই আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে সে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। আদম (আ.) নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, সত্যপন্থির কোরবানিই গ্রহণযোগ্য হবে। শুধু আদম (আ.) নয়, আল্লাহর নবী হজরত নূহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত মুসা (আ.) সব নবীর উম্মতের ওপর কোরবানি ছিল। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম, আল্লাহর প্রেমে, স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন ইবরাহিম (আ.) আল্লাহতায়ালা বলেন, অতঃপর ইসমাইল (আ.) যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়স উপনীত হলো তখন ইবরাহিম (আ.) বলল, হে বৎস আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে আমার আব্বাজান আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল সন্তান হিসেবে দেখতে পাবেন। (সুরা সফফাত আয়াত : ১০৩)
হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি এটা ছিল আল্লাহর পরীক্ষা, তাই পিতার ধারালো অস্ত্র দিয়ে সন্তান ইসমাইল (আ.)-এর একটি পশমও কাটতে পারেনি, পরে আল্লাহর হুকুমে জান্নাতের একটি দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টার প্রেমে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগের উদাহরণ। তারই ধারাবাহিকতায় হযরত ইব্রাহিম আ. সুন্নাহকে জারি রাখা হচ্ছে।
কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ইসলামে কুরবানির অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। কুরবানির মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর প্রিয়ভাজন ও মুত্তাকি হিসেবে উপনীত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তোমাদের কোরবানির গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছাই তোমাদের তাকওয়া। (সুরা হজ্জ আয়াত নম্বর :৩৭)
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়। ( ইবনে মাজাহ হাদিস নং ২৫৩২)
যায়েদবিন আরকাম (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানীর পশুগুলির তাৎপর্য কি? (কেন আমরা এগুলো যবেহ করে থাকি?) তিনি বললেন: “ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নত।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, এতে আমাদের কী সওয়াব রয়েছে? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, পশমের মধ্যে যে ছোট ছোট লোম রয়েছে ওগুলোরও কি বিনিময় তাই? নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ছোট ছোট প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” (ইবনু মাজাহ্ হদিস নং ৩১২৭)
কুরবানির উদ্দেশ্য : কুরবানি শুধু বনের পশুর গলায় ছুড়ি চালানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং মনের মধ্যে যাবতীয় পশুত্বের স্বভাব (হিংসা,অহংকার, গীবত, পরচর্চা, অশ্লীল সকল কর্মকান্ডকে) জবাই করতে হবে। এবং একজন তাকওয়াবান বান্দা হিসেবে পরিগনিত হওয়া। আল্লাহ বলেন, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তোমাদের কোরবানির গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছাই তোমাদের তাকওয়া। (সুরা হজ্জ আয়াত নম্বর :৩৭)
আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের পক্ষ থেকে কোরবানি কবুল করেন। (সুরা আল মায়িদা, আয়াত : ২৭)
নিজের সকল তন্ত্র মন্ত্রকে আল্লাহর মতের মধ্যে সপে দিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রবের বিধানে বশ্যতা স্বীকার করা। যেমনটা হযরত ইব্রাহিম আ. দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুক।