মৌলভীবাজার শহরে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে অটোরিকশার হর্ণে, আর সন্ধ্যায় শহর ঘুমায় তারই গুঁইগুঁই শব্দে। দিনের যে কোনও সময় শহরের যে কোনও রাস্তায় দাঁড়ালে দেখা যাবে — শত শত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রাস্তায় দাঁড়িয়ে, গাদাগাদি করে যাত্রী তুলছে কিংবা ট্রাফিক জ্যামের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ এর বেশিরভাগই কোনও লাইসেন্স ছাড়া চলাচল করছে। পার্টস বিক্রির লাইসেন্সে চলছে সম্পূর্ণ অটোরিকশা বিক্রি, শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে যানজটের পাহাড়।
লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা: আড়ালে চলছে গোপন বানিজ্য। যেসব দোকানে “অটোরিকশার যন্ত্রাংশ বিক্রি হয়” বলে সাইনবোর্ড ঝুলছে, সেসব দোকানে গিয়ে দেখা যায় — কেবল পার্টস নয়, একদম চালু অবস্থায় সম্পূর্ণ অটোরিকশাও বিক্রি হচ্ছে।
নামমাত্র একটি ট্রেড লাইসেন্স দেখিয়ে মাসে ডজন ডজন ব্যাটারিচালিত অটো বিক্রি করা হচ্ছে ৭০-৯০ হাজার টাকায়। দোকানের পেছনের ঘর, পাশের গ্যারেজ কিংবা অন্য কোনও স্টকে সাজানো থাকে এই যানগুলো। ক্রেতা এসে দরদাম করে টাকা দিলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্যারেজ থেকে তাকে চালু অটো বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অধিকাংশই জানেন না যে এ ধরনের যানবাহন পরিচালনার জন্য সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন।
একজন চালক বলেন:
“দোকানদার বলেছে, এসব অটোর জন্য লাইসেন্স লাগে না। পুলিশ মাঝে মাঝে ধরলেও টাকা দিলে ছেড়ে দেয়। তাই আমরাও ভেবে নিই, চালিয়ে গেলে সমস্যা নেই।”
অনেক চালক আবার জানান, শহরের অনেকেই এই অটো চালাচ্ছেন আয় রোজগারের জন্য, কিন্তু কোথাও থেকে নিয়মিত লাইসেন্স সংগ্রহের কোনও ব্যবস্থাই নেই।
অতিরিক্ত লাইসেন্সবিহীন অটোরিকশার কারণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট — চৌমুহনা, কুসুমবাগ, নিউমার্কেট, এস.এম. রোড, কলেজ রোডে দিনে বহুবার তীব্র যানজট লেগে থাকে। ফুটপাতও দখল হয়ে যায় অটোর যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায়।
শুধু যানজট নয়, দুর্ঘটনাও বেড়েছে। কারণ, চালকদের বেশিরভাগেরই কোনো প্রশিক্ষণ নেই, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জানাশোনা নেই, আবার কেউ কেউ ১৪-১৫ বছরের কিশোরও।
বেশিরভাগ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ব্যবহৃত হচ্ছে নিম্নমানের ব্যাটারি, যেগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই বিকল হয়ে যায় এবং যথাযথভাবে নিষ্পত্তি না হওয়ায় পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। অধিকাংশ দোকানে ব্যাটারির ডিসপোজাল বা রিসাইক্লিংয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই, ফলে ব্যবহৃত অ্যাসিড ও সীসা দূষিত করছে মাটি ও পানি।
ব্যবসায়ীরা এই লাইসেন্সবিহীন ব্যাটারি অটো বিক্রি করে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। যেখানে একটি খুচরা পার্টস দোকান থেকে আয় সীমিত, সেখানে পুরো অটো বিক্রি করে একেকজন ব্যবসায়ী অল্প সময়ে মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।
একজন গ্যারেজকর্মী জানান:
“আমাদের এখানে প্রতিদিন তিন-চারটা অটো তৈরি হয়। কাস্টমার অর্ডার দিয়ে রাখে। বাইরের জেলা থেকেও লোক আসে কিনতে।”
যেহেতু অটোরিকশাগুলোর রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্সিং কিংবা চলাচল সংক্রান্ত কোনও কেন্দ্রীয় রূপরেখা নেই, তাই এসব যানবাহন শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক বিশৃঙ্খল চিত্র তৈরি করেছে। একজন সচেতন নাগরিক বলেন:
“একটা শহরে যদি হাজারখানেক অটো চলে অথচ তার লাইসেন্সই না থাকে, তাহলে কেমন শহর বলুন?”
সম্ভাব্য সমাধান: বাস্তববাদী পরামর্শ:
১. অটোরিকশা নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালু করা:
যান্ত্রিকভাবে নিরাপদ ও নির্দিষ্ট মানের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার জন্য পৌরসভা বা জেলা পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশন চালু করা উচিত।
২. ট্রেড লাইসেন্স যাচাই ও পর্যবেক্ষণ:
যারা “পার্টস বিক্রির” ট্রেড লাইসেন্সে সম্পূর্ণ অটো বিক্রি করছেন, তাদের ব্যবসায় কার্যক্রম পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম:
চালকদের ট্রাফিক আইন, নিরাপদ চলাচল ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে।
৪. শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:
যানবাহনের ধরণ, অনুমতি ও সংখ্যার উপর ভিত্তি করে শহরের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবহন নীতিমালা তৈরি করা জরুরি।
মৌলভীবাজার শহরের যানজট, পরিবেশ দূষণ ও নাগরিক ভোগান্তির অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে লাইসেন্সবিহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এর সমাধান একদিনে আসবে না, তবে যদি নিয়ন্ত্রণহীন বিক্রি বন্ধ না করা হয়, এবং ব্যাবসায়িক স্বার্থকে আইনের বাইরে ছাড় না দেওয়া হয় — তাহলে শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।