২০২৪ সালের ৪ আগস্ট মৌলভীবাজারের ইতিহাসে যেন এক অগ্নিস্নান দিবস। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র ও জনতার গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল ছিল শহর, আর সেই আন্দোলনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সাহসী কিছু সাংবাদিক লড়েছিলেন না শুধু কলম দিয়ে, বরং বুক চিতিয়ে সত্যের পক্ষে। রাবার বুলেট, টিয়ার শেল আর লাঠিপেটার মধ্যে থেকেও যারা সংবাদ সংগ্রহে ছিলেন অটল, আজ তাদের খবর কেউ রাখেনি। বরং যারা নিরাপদে ঘরে বসে আন্দোলনের নামে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন, তাদের গলায় ঝুলেছে তথাকথিত “আহত সাংবাদিক” এর পদক।
আহত সাংবাদিকদের অভিযোগ, এক বছর পার হলেও তাদের কেউ ফোন করে খোঁজ নেয়নি, সরকারি কোনো তালিকায় নাম ওঠেনি, বরং যারা মাঠে ছিল না, যারা পুলিশের সঙ্গে কৌশল বিনিময় করেছে, তাদেরই দেওয়া হয়েছে সরকারি স্বীকৃতি ও সম্মাননা। এক সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার মাথায় লাঠি পড়েছে, বাইক ভেঙে গেছে, রক্ত ঝরেছে – কিন্তু স্বীকৃতি পেল সেই ব্যক্তি, যে পুলিশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নাটক করেছে ! আমার কাছে আজও ভিডিও ফুটেজ আছে- কারা দালালি করেছে, কারা সাংবাদিকতার মুখোশ পরে গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।”
২০২৪ সালের সেই ৪ আগস্ট সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের প্রতিটি মোড়ে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, টিয়ার শেলের ধোঁয়া আর মানুষের আর্তনাদ চলছিল। ওই অবস্থাতেও কিছু সাংবাদিক ছিলেন অটল। তারা জানতেন—এই লড়াই শুধু ছাত্রদের না, এটি ছিল গণতন্ত্রের পক্ষে সত্যের একটি যুদ্ধ। অনেকে মাথা, পা ও পিঠে গুরুতর আঘাত পান। সরকারি হাসপাতালে যেতে না পেরে অনেকেই প্রাইভেট ক্লিনিকে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। কেউ কেউ এখনও শরীরের ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু ব্যথার চেয়েও বড় যন্ত্রণা—অবহেলা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি শাহ মিসবাহ বলেন, “জুলাই আন্দোলনের সময় সাংবাদিক ভাইয়েরা আমাদের পাশে ছিলেন, মাঠে ছিলেন। তারা গুলির মুখে সত্য তুলে ধরেছেন। তারা সাংবাদিক না, তারা একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আজ যারা শুধু নাটক করেছে, তারা সরকারি সম্মান পাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
এদিকে মৌলভীবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “আমরা নিজ চোখে দেখেছি—কেউ মাঠে ছিল, কেউ পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আজ স্বীকৃতি যাচ্ছে সেই দালালদের ঘরে, আর সত্য তুলে ধরা সহকর্মীরা রয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দ, নিঃস্ব। এটা সাংবাদিকতার অপমান, এটা সত্যের বিরুদ্ধে এক নীরব ষড়যন্ত্র।”
প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌলভীবাজারের তথ্য অফিসার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “আহত সাংবাদিকরা সিভিল সার্জনের কাছ থেকে প্রত্যয়ন নিয়ে ডিসি বা ইউএনও বরাবর আবেদন করলে বিবেচনা করা হবে।” যদিও বাস্তবে এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন ভুক্তভোগীরা।
মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মামুনুর রহমান জানান, “আমরা আহত সাংবাদিকদের চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছি। যারা সত্য তুলে ধরেছে, আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছে, তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। তবে যারা রাজনৈতিক পক্ষ নিয়ে স্বৈরাচারের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদের এই ক্যাটাগরির বাইরে রাখা হবে।”
এই হলো সেই সাংবাদিকদের গল্প—যাদের হাতের কলমে ছিল আগুন, যাদের পায়ের ছাপে ছিল সংগ্রামের ধুলা। কিন্তু আজ তারা অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। তারা শুধু একখানা সনদ চায় না, চায় রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, চায় ন্যায়ের ফেরত।