বাংলাদেশের কারাগারব্যবস্থা যেখানে সংশোধনের প্রতীক হওয়ার কথা, সেখানে মৌলভীবাজার জেলা কারাগার রূপ নিয়েছে এক ‘রাষ্ট্রপ্রযোজিত নির্যাতনকেন্দ্রে’। এই কারাগারের ‘প্রধান নির্যাতন কর্তা’ হিসেবে উঠে এসেছে জেল সুপার মুজিবুর রহমান মজুমদার—যিনি কারা প্রশাসনের পরিচয়েই গড়ে তুলেছেন এক মাফিয়া সাম্রাজ্য। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে তা শুধু ভয়াবহ নয়, রাষ্ট্রের মানবাধিকার চেতনাকেই উপহাস করে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান বলছে:
এই একজন ব্যক্তি বন্দিদের থেকে শুরু করে সরকারের বরাদ্দ, ফোন ব্যবস্থাপনা, ওষুধ, এমনকি সিটও বানিজ্যের আওতায় এনেছেন। তাঁর ক্ষমতার দম্ভ এতটাই যে, নিজেকে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি, আবার জামায়াতের নেতা হিসেবেও দাবি করে থাকেন—যাতে কেউ ঘাঁটাতে না পারে।
বন্দিরা যেন ‘লুকিয়ে বেঁচে থাকা’ প্রাণী!
প্রতিদিনের খাবারে থাকে আধা পঁচা চাল, পানি দিয়ে গুলিয়ে বানানো ডাল, কাঁচা পচা সবজি। অথচ সরকারি বরাদ্দ আছে প্রতিদিন একেক বন্দির জন্য উন্নত মানের খাবার! এসব খাবার বাইরে বিক্রি করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা কামাচ্ছে জেল সুপার ও তার সিন্ডিকেট।
একজন প্রাক্তন বন্দি বলেন, “দুই মাস ছিলাম সেলে। খাবার মুখে তোলার মতো না। টাকা না পাঠালে না খেয়ে থাকতে হতো। বাথরুমে যেতে হলেও টাকা লাগত।”
মোবাইল ফোন চালাতে হয় ‘টেরোর ট্যারিফে’!
কারাগারে বৈধ মোবাইল ফোন ব্যবস্থাও এখন দুর্নীতির অন্যতম হাতিয়ার। নিয়ম অনুযায়ী ৭ দিন পর পর ৫ মিনিট কথা বলার অনুমতি থাকলেও, জেল সুপারের সিন্ডিকেটে রয়েছে “প্রিমিয়াম প্যাকেজ সার্ভিস”—যেখানে টাকা দিলে চলে ভিডিও কল, ভয়েস কল, এমনকি অনলাইন ট্রানজেকশনও!
সাধারণ বন্দি নয়, এখানে ফোন চালায় ইয়াবা কারবারিরা!
প্রতিদিন মোবাইল সার্ভিস থেকে আয় হয় ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। অথচ সবকিছু ঘটে জেল সুপারের অনুমতিতে!
‘সিট’ পেতে ঘুষ দিতে হয় ৫০ হাজার! না দিলে মেঝেতে ঘুম!
কারাগারে সিট মানে আরামের স্বপ্ন। কিন্তু সেই সিট কিনতে হয় হাজার হাজার টাকা দিয়ে! ঘুষ না দিলে বন্দিকে ফেলে রাখা হয় গুমোট গন্ধযুক্ত মেঝেতে, যেখানে টিকটিকি, পোকামাকড়ের সাথেই রাত কাটে। একাধিক সূত্র বলছে, ভেতরের এই সিট বাণিজ্যে শুধু জেল সুপার নয়, সংশ্লিষ্ট দারোগা, ওয়ার্ডেনরাও জড়িত। ‘ব্লক’ বরাদ্দও এখন মাসিক লিজে চলে!
সরকারি হাসপাতালের বেড বিক্রি করে লাখপতি!
কারা হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে অসুস্থ হতে হয় না—লাখ টাকা দিলেই আপনি VIP বন্দি!
শুধু বেডের জন্য নেয়া হয় মাসে ৬-৮ হাজার টাকা।
আর যারা টাকা দিতে পারে না, তাদের ঠাঁই হয় ঘিনঘিনে টয়লেটের পাশে মেঝেতে। অসুস্থ বন্দিদের ওষুধ বিক্রি করে আয় হয় আরও কয়েক হাজার টাকা। অর্থনীতি নয়, এই কারাগার চালায় ‘সন্ত্রাসের শৃঙ্খল’।
কারা অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে এক ‘অদৃশ্য ক্যাসিনো সিস্টেম’। যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে টাকা লাগে—
পানির জন্য: ২০ টাকা, রান্নার জায়গার জন্য: ৩০ টাকা, কাপড় ধোয়ার জন্য: ৫০ টাকা, পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে: ৫০০ টাকা, ডিম: ৭০ টাকা, মাছের টুকরো: ২০০ টাকা। এই টাকার একটা অংশ জেল সুপারের একান্ত লোকের মাধ্যমে প্রতিদিন তার ব্যক্তিগত একাউন্টে চলে যায় বলে অভিযোগ।
ক্ষমতার অপব্যবহারে বাধাহীন ‘কারাগার চক্র’!
জেল সুপার একদিকে উচ্চ মহলে নিজেকে রাজনৈতিক লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে রক্ষা পায়, অন্যদিকে জেলে সাধারণ বন্দিদের গণহারে নির্যাতন করেন। একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, “এই লোক নিজেকে প্রতিদিনই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য বলে। কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি, আবার জামায়াত! তার একটাই উদ্দেশ্য—কেউ যেন তার বিরুদ্ধে মুখ না খুলতে পারে!”
দুদকের তদন্তেই উন্মোচিত হচ্ছে ‘কারাগার কর্পোরেশন’-এর চিত্র!
দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে এই মুহূর্তে জেল সুপার মুজিবুর রহমান, তার স্ত্রী ও সন্তানের নামে সম্পদের খোঁজ চলছে। চিঠি গেছে ব্যাংক, ভূমি অফিস, নিবন্ধন অধিদপ্তরে।
সূত্র বলছে—“কারা ভবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন, তা এখন রাষ্ট্রের জন্যই প্রশ্ন।”
এই কি সেই ‘সংশোধনের কারাগার’?
প্রতিটি দিন এখানে বন্দিরা আতঙ্ক নিয়ে বাঁচে। কখন কে নির্যাতনের শিকার হবে, কে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাবে—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পরিবারগুলো আর্তনাদ করে—“আমরা সন্তানকে সংশোধনের জন্য পাঠিয়েছিলাম, মরার জন্য নয়!”
শেষ প্রশ্ন—এই ভয়াবহতার দায় কার? সরকার কি দেখছে না? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছে?
সাংবাদিকতা থামবে না—কারণ আলো থামলে অন্ধকার জিতে যাবে।