বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং নদী অববাহিকার বালিতে লুকিয়ে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার পারমাণবিক ও কৌশলগত খনিজ সম্পদ রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (REEs) নিয়ে দেশীয় নিষ্ক্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের এক ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
একদিকে যখন চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই “একবিংশ শতাব্দীর সোনার” নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক অদৃশ্য যুদ্ধে লিপ্ত, তখন বাংলাদেশ তার পায়ের নিচের এই মহামূল্যবান সম্পদ উত্তোলনে রহস্যজনকভাবে নীরব। বিশেষজ্ঞরা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই নীরবতা শুধু অর্থনৈতিক আত্মহত্যার সামিল নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিগত নিরাপত্তাকে এক গভীর খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (BAEC) এবং ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (GSB) গবেষণায় কক্সবাজার থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সমুদ্র সৈকত এবং যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের বালুচরে জিরকন, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, রুটাইল, গারনেট এবং ম্যাগনেটাইটের মতো অন্তত ১৭টি ভারী খনিজের বিপুল মজুত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
এই খনিজগুলোই হলো নিওডিয়ামিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, সেরিয়াম এবং ল্যান্থানামের মতো সেই বিরল মৃত্তিকা মৌলের (REEs) উৎস, যা ছাড়া আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, স্যাটেলাইট, সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রিক গাড়ি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি অচল।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রায় পাঁচ দশক আগে এই সম্পদ আবিষ্কৃত হলেও কেন আজও বাণিজ্যিক উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলো না? কেন এই খাতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নীতিমালা পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি?
আন্তর্জাতিক বাজারে রেয়ার আর্থের চাহিদা যখন আকাশচুম্বী এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে এর সরবরাহ শৃঙ্খল যখন অত্যন্ত নাজুক, তখন বাংলাদেশের এই নিষ্ক্রিয়তা একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি সূত্র বলছে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক একটি শক্তিশালী চক্র বাংলাদেশের এই সম্পদ উত্তোলনে বাধা সৃষ্টি করছে। তাদের উদ্দেশ্য-বাংলাদেশকে একটি দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে রেখে কম মূল্যে এই কৌশলগত সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া অথবা বাংলাদেশকে এই বাজার থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন রাখা, যাতে নির্দিষ্ট কোনো দেশের একক আধিপত্য বজায় থাকে।
বিশ্বের ৭০% রেয়ার আর্থ উৎপাদন এবং ৯০% প্রক্রিয়াকরণ নিয়ন্ত্রণকারী চীন যখন সরবরাহকে একটি ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মরিয়া হয়ে বিকল্প খুঁজছে। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের বিপুল সম্পদ আন্তর্জাতিক শক্তির রাডারে রয়েছে, এটি নিশ্চিত।
অভিযোগ রয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগের নামে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও কোম্পানি এই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য পর্দার আড়ালে তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বাংলাদেশ কোনো দর-কষাকষির সুযোগই পাচ্ছে না।
রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস কোনো সাধারণ খনিজ নয়। এটি একটি দেশের কৌশলগত সক্ষমতার প্রতীক। এর গুরুত্ব কয়েকটি দিক থেকে অনুধাবন করা জরুরি:
প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব: আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের মূল উপাদান হলো REE। এই সম্পদের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকা মানে জাতীয় নিরাপত্তাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া।
অর্থনৈতিক মুক্তি: বাংলাদেশের আবিষ্কৃত রেয়ার আর্থ খনিজের আনুমানিক বাজারমূল্য কয়েক বিলিয়ন ডলার। এই সম্পদ সঠিকভাবে উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারত, যা পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পের অর্থায়নেও সহায়ক হতে পারত।
প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা: চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিক্সের ভিত্তি গড়ে উঠেছে REE-এর ওপর। এই খাতে পিছিয়ে পড়া মানে প্রযুক্তির কাছে নত হয়েই থাকা, উদ্ভাবক হওয়া নয়।
সবচেয়ে লজ্জাজনক বাস্তবতা হলো, যখন বাংলাদেশ তার সম্পদ নিয়ে ঘুমাচ্ছে, তখন প্রতিবেশী দেশগুলো একই ধরনের সম্পদ কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। ভারত তার “ইন্ডিয়ান রেয়ার আর্থস লিমিটেড” (IREL) এর মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে উপকূলীয় খনিজ থেকে বিপুল পরিমাণ আয় করছে।
মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের উৎপাদন বাড়াচ্ছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়া, যারা সম্প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে, তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম REE উৎপাদনকারী দেশ।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (BMD), GSB এবং BAEC-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের সামিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আর কোনো সমীক্ষা বা আলোচনার সময় নেই। সরকারকে অবিলম্বে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একটি “জাতীয় রেয়ার আর্থ টাস্কফোর্স” গঠন করতে হবে এবং যুদ্ধকালীন তৎপরতায়-
নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে:
১. নীতি ও আইন প্রণয়ন: আগামী ছয় মাসের মধ্যে REE উত্তোলন, পরিশোধন, রপ্তানি এবং পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য একটি কঠোর ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক দরপত্র: কোনো একক দেশের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে স্বচ্ছ আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগের জন্য সেরা অংশীদার নির্বাচন করতে হবে।
৩. রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকরণ: যৌথ বিনিয়োগ হলেও এই কৌশলগত সম্পদের ওপর রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পাইলট প্রকল্পের বাণিজ্যিক রূপান্তর: কক্সবাজারের পাইলট প্ল্যান্টটিকে অবিলম্বে বাণিজ্যিক উৎপাদনে উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে।
যদি সরকার এই সম্পদ রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তবে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। বাংলাদেশের মাটির নিচে থাকা এই বিলিয়ন ডলারের সম্পদ হয় বালিতেই মিশে থাকবে, অথবা বিনামূল্যে বিদেশি শক্তির হাতে চলে যাবে। এর দায়ভার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের।