মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রাম যেন ঘুমের ঘোরে ডুবে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, এক অদৃশ্য অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে—কারও চিৎকার নেই, তবুও আছে মৃত্যুর হিম শীতল উপস্থিতি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই উন্মোচিত হয় এক রক্তাক্ত সত্য—খাটের ওপর পড়ে আছে ২৬ বছরের আব্দুর রহিম রাফির গলাকাটা নিথর দেহ, আর সেই দেহের রক্ত শুকানোর আগেই ধরা পড়ে খুনির নাম—নিজের ছোট ভাই!
কথা ছিল, দুই ভাইয়ের সম্পর্ক রক্তের বাঁধনে অটুট থাকবে। কিন্তু পরিবারের ভেতরের অস্থিরতা, বাবাহারা সংসারের দায়িত্বের চাপ আর জমে থাকা অভিমান এ সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলেছিল অনেক আগেই। তদন্তে জানা যায়, হত্যার আগের দিন ছোট ভাই মাত্র ৫০০ টাকা চাইতে গেলে রাফি তা ফিরিয়ে দেন এবং কঠিন ভাষায় অপমান করেন। সেই অপমান রাতের অন্ধকারে রূপ নেয় এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তে—প্রতিশোধ নিতে হবে, যেকোনো মূল্যে।
৯ আগস্ট সকালে বাড়িতে কেউ নেই। সুযোগ বুঝে খাটের নিচ থেকে বের করে আনে লুকানো ধারালো দা। ঘুমন্ত রাফির ঘাড়ে প্রথম কোপ পড়তেই চারপাশ লাল হয়ে ওঠে। থেমে যায় না হাত—দ্বিতীয়, তৃতীয়… যতক্ষণ না নিঃশ্বাস থেমে যায়। এরপর দা ধুয়ে খাটের নিচে রেখে দেয়, নিজের রক্তমাখা লুঙ্গিও সেখানে লুকিয়ে ফেলে। মুখে এমন ভাব, যেন কিছুই হয়নি।
পুলিশ খবর পাওয়ার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নোবেল চাকমা, শ্রীমঙ্গল সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান ও কমলগঞ্জ থানার ওসি আবু আফর মোঃ মাহফুজুল কবির। গোপন সূত্র, প্রযুক্তি ও স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হয় ১৬ বছরের কিশোর খুনিকে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পুলিশের প্রশ্নের জালে আটকে গিয়ে হুবহু বর্ণনা দেয় হত্যার প্রতিটি মুহূর্তের।
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে পারিবারিক দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ইতিহাস—বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই অভিভাবকের ভূমিকা নিতে গিয়ে ছোট ভাইকে পড়াশোনায় বাধ্য করতেন। কিন্তু পড়াশোনায় অনীহা, ঘরে অলস সময় কাটানো, নিয়মিত শাসন, আর পারিবারিক অমতে রাফির বিয়ে—সব মিলিয়ে ঘরে ঘরে জন্ম নেয় শীতল যুদ্ধ। বছর ধরে জমে থাকা সেই ক্ষোভ শেষমেষ বিস্ফোরিত হয় এক ভোরের রক্তাক্ত দৃশ্যে।
খাটের নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া দা এবং রক্তমাখা লুঙ্গি এখন আদালতের প্রমাণ হিসেবে কথা বলছে। নিহতের মা মনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে কমলগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন (মামলা নং-০৫, তারিখ-১০/০৮/২০২৫, ধারা ৩০২/৩৪ পেনাল কোড)। সিদ্ধেশ্বরপুরের এই ভোর দেখিয়ে দিল—মাঝে মাঝে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রু ঘরের চার দেওয়ালের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে।