স্বৈরাচার সরকার পতনের পর থেকেই প্রশাসন অনেকটা নিরব ভূমিকা পালন করায় দেশের বিভিন্ন জেলাতে মাদকের ছড়াছড়ি বেড়েই চলেছে।। এ সুযোগে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরে আবারও তৎপর হয়ে উঠেছে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীরা। এর আগে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চালিয়ে আসা মাদক কারবারিরা এখন আত্মগোপনে আছেন। তবে খোলস পাল্টিয়ে অনেকেই এখনো দিব্যি চালাচ্ছেন মাদকের কারবার।
তবে এবার ক্ষমতার পালাবদলে নতুন কারবারিরও সৃষ্টি হয়েছে। মোদ্দাকথা দুই উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে অর্ধশত স্থায়ী ও ভ্রাম্যমান মাদক কারবারিরা এখন মিলেমিশে খাচ্ছে রামগতি ও কমলনগর। এতে চরমভাবে ধ্বংসের মুখে পড়েছে এলাকার যুব সমাজ। ভয়াবহ এ মাদকের ছোবল থেকে যুবসমাজকে রক্ষায় জরুরি প্রশাসনিক অভিযান জোরদার করার দাবি সতেন মহলের।
সূত্র জানিয়েছে, এ অঞ্চলের কতিপয় মাদক কারবারি ইয়াবার জন্মভূমিখ্যাত মিয়ানমার থেকে নদী এবং সড়কপথে সরাসরি আমদানি করছে মরণনেশা ইয়াবা। ছোট এবং মাঝারি অন্তত অর্ধশত ব্যবসায়ীদের মাঝে মুহুর্তেই তা ছড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করছে তারা। তবে রাজনৈতিক শক্তি এবং অজানা কারণে নিজেরা বরাবরই রয়ে গেছে অদৃশ্য এবং অধরা।
সুত্র আরও জানায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকার-নারায়নগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের সন্ধীপ থেকে নদীপথে রামগতি ও কমলনগরে বেশিরভাগ ইয়াবার চালান আমদানি করা হয়। অপরদিকে সড়ক পথে নোয়াখালীর হানিফ রোডের মান্নান নগর ও সুবর্ণচর থেকে সড়ক পথে কমলনগর এবং রামগতির বিভিন্ন স্পটে প্রবেশ হচ্ছে ইয়াবা ও গাঁজা। যা অনেকটা প্রকাশ্যেই এখন বিক্রি হচ্ছে। মাদক সেবন এবং বিকিকিনিতে পাড়া মহল্লায় বেড়েছে কিশোরগ্যাংয়ের দৌড়াত্ম। যুবকরা নেশায় বুদ হয়ে মাঝে মধ্যেই ঘটাচ্ছে সংঘর্ষ ও মারামারি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে মাদকের অর্ধশত স্পট রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ স্পটের সংখ্যাই বেশি। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এসব স্পটে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন ধুমধারাক্কা।
এদিকে রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আজাদনগর এলাকার মহিউদ্দিনের ছেলে মো. সমির, তাহেরের ছেলে মুরাদ, এমচি বাড়ির মিন্টু, বেইজ্জাপাড়ার বেইজ্জা হারুন, আমির হোসেন, রফিকুল হকের ছেলে গিয়াস উদ্দিন প্রকাশ্যেই গড়ে তুলেছে মাদকের আখড়া। একই ইউনিয়নের হাজিগঞ্জ শেখের কিল্লা এলাকায়ও চলছে বিকিকিনি। চর আলগী ইউনিয়নের সুফিরহাট এলাকার খোরশেদ মাওলানার ছেলে মাদক ব্যবসায়ী যোবায়ের জেলে থাকলেও বেচুমিয়ার ছেলে রহিম এখনও করছেন মাদক ব্যবসা।
এছাড়া বালুরচর, জনতাবাজার বেড়ির উপর, জমিদারহাট মহিলা কলেজ এলাকা, আশ্রম পোলেরগোড়া, চরসেকান্তর রাস্তার মাথা, রামগতি পৌরসভার সামনে, আলেকজান্ডার বাসস্টেশন, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন প্রশিকা অফিস, রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে, হাজিগঞ্জ ছাত্রী ছাউনি, বিবিরহাট যাত্রী ছাউনি ও গরু হাটা এলাকা, রামদয়াল দক্ষিণ বাজার, রামগতি বাজার মির রোড, কলেজ রোড, টাংকি বাজার, সেন্টাল মার্কেট, তেগাছিয়া বাজার, জয়নাল মুহরীর গোঁজ, তেমুহনী এলাকা, বিবিরহাট মাজার রোড ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের ফজুমিয়ারহাট হাটের পুর্ব পাশে ও উত্তরে কাটাখালির মোড়, ভূলুয়া নদীর দু’পাশে মাছের প্রজেক্ট, চরঠিকা আছিয়ার বাপের সমাজ, চরঠিকা আছিয়ার বাপের খেয়া সংলগ্ন আশ্রয়ন প্রকল্পে, চরবসু বাজার ও বটতলী এলাকায় মাদক সেবন ও ক্রয় বিক্রয়সহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় অপরাধীরা। এবিষয়ে এলাকাবাসীর উদ্যোগে সম্প্রতি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হলেও অজানা কারণে মাদক সেবন ও বিকিকিনি বন্ধ হয়নি এখনো। এছাড়া হাজিরহাট ইউনিয়নের হাজিরহাট বাজার তালপট্টি রোড, খাদ্যগুদাম সংলগ্ন হিন্দু বাড়ি, করুনানগর সিনেমা হল, আনন্দ বাজার, হাজিরহাট মেঘনা সিনেমা হলের সামনে, মৌলভীরটেক, সোনারবাংলা আশ্রয়ণে মাদক সম্রাট জামাই শাহজান, মাদক সম্রাজ্ঞী নুরনাহার ও ওসমান নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের ব্যবসা।
চর লরেন্স ইউনিয়নের চুঙারগোড়া এলাকার মুন্নি তার স্বামী আনোয়ার রাস্তার পাশে ঝুঁপড়িঘরে দেহ ব্যবসা ও মাদক বেচাকেনা করার ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া একই ইউনিয়নের বাশতলা এলাকার মৃত কাশেমের ছেলে মো. কবির, তোরাবগঞ্জ এলাকার ইসমাইল মেম্বারের চাচাত ভাই মাইন উদ্দিন নির্ভয়ে সামলাচ্ছে মাদক ব্যবসা।
অন্যদিকে, চরমার্টিন ইউনিয়নের শাহ আলম মেম্বারের দরজা নিকটবর্তী একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ওই এলাকার আবু কালাম বেপারীর জামাই মামুন, রাজনের ছেলে মোস্তফা ও বাবুলের ছেলে স্বপনের নেতৃত্বে প্রতি রাতেই বসে মাদকের হাট। এছাড়াও চৌধুরী বাজার এলাকার মারুফ নামের একজন পর্দার আড়ালে থেকে এবং ও এলাকার চিহিৃত মাদক কারবারি গনির শীষ্য শাহআলম সামলাচ্ছে ইয়াবা ও গাঁজার ব্যবসা। নাছিরগঞ্জ এলাকা সামলাচ্ছে আবু তাহের, আব্দুর রহিম। আবু মেম্বারের বাড়ির দরজা, ডাক্তারপাড়া এলাকার ছাত্রলীগের এক পাতি নেতা পলাতক থাকায় চলছে ভ্রাম্মমান মাদক বিকিকিনি ও সেবন। এছাড়া বাত্তিরখাল মাছঘাটে প্রকাশ্যে চলছে গাঁজা সেবন।
অন্যদিকে পাটারিরহাট, খায়েরহাট, চর ফলকন, তোরাবগঞ্জ বাজারের উত্তর মাথায় বেদে পল্লীর আখড়া, চরমার্টিন শান্তিরহ্টা, ইসলামগঞ্জ, রহিমগঞ্জ, রববাজার সরকারি পুকুরপাড় এলাকায় হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক লোকজন জানায়, মাদক বিকিকিনি ও সেবনকারীরা রাতের বেলায় তৎপর হয়ে উঠে। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অচেনা লোকজনের আনাগোণা বেড়ে যায়। আবার কখনো মোটরসাইকেল কখনো সিএনজি হয় মাদক সরবরাহের বাহন।
একাধিক সূত্র জানায়, দু’উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঢেড়া বানিয়ে বাস করছে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। মাদক কারবারের সঙ্গে এরাও জড়িত। এরা সাপের বাক্সে করে অভিনব কায়দায় গ্রামের বিভিন্ন যায়গায় মাদক সরবরাহ করে থাকে। আবার বড় ডিলাররা পাইকারদের কাছে মাদক পৌঁছে দেওয়ার কাজে বেদে পল্লীর লোকজনকে কাজে লাগায় বলে জানান তারা।
সচেতন মহলের দাবি, একসময় রামগতি-কমলনগরে ফেনসিডিল, গাঁজা ও মদের ব্যবসা করতেন গুটিকয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী। তাও খুব গোপনে বেচাকেনা হতো। এখন গাঁজা-মদের পাশাপাশি চলছে মরণনেশা ইয়াবা ট্যাবলেটের রমরমা ব্যবসা। তবে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরাও এ কাজে জড়িত, প্রসাশন এদেরকে আটক করার পর হাজতে পাঠালেও অজানা কারণে বেড়িয়ে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
করইতলা বাজারের ব্যবসায়ী ফিরোজ আলম বলেন, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাদক ব্যবসায় ঝুঁকছে। পুরুষরা নারীদের শেল্টার দিচ্ছে। এসব লোকজন যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের নাম ভাঙিয়ে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে অনেক নামিদামি সমাজসেবকরা মানবসেবকের তকমা লাগিয়ে তাদের পোষ্য বাহীনিকে দিয়ে গোপনে চালাচ্ছেন ভয়াবহ মাদক ব্যবসা, তবে কুখ্যাত এই মাদক ব্যবসায়ী জনসেবকরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
কমলনগর থানার (ওসি) তওহিদুল ইসলাম ও রামগতি থানার ওসি মুহাম্মদ কবির হোসেন বলেন, মাদকের সঙ্গে কোনো আপস নেই। মাদককে নিয়ন্ত্রণে আনতে জিরো টলারেন্স নীতি চালু রয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে একাধিক মামলাও করেছে। মাদক বিকিকিনির সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় নয় বলে জানান তিনি।