বগুড়ায় বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির ফল চাষে আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। প্রথমে শখের বসে বিদেশি এসব ফলের চাষ শুরু করলেও পরে তারাই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- আমের মধ্যে সুর্যডিম, মিয়াজাকি, পালমার, কিউজাই, ব্যানানা ম্যাংগো, ভারত সুন্দরী, কিং অব চাকাপাত চাষ করা হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য ফলের মধ্যে ত্বিন, করোসল, ননি, নাগফল, বারাবা, লোকাট, স্ট্রবেরি, এপ্রিকট, ড্রাগন, হলুদ মালটা, ডকমাই, কাজু বাদাম, অ্যাভোকাডো, সাম্মান, আজোয়া খেজুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি ফল চাষ করা হচ্ছে।
১২ বিঘা জমিতে অর্গানিক পদ্ধতিতে ড্রাগন
বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর উপজেলার ফুলকোট গ্রামের মিজানুর রহমান ১২ বিঘা (চার একর) জমির ওপর অর্গানিক পদ্ধতিতে ড্রাগনের বাগান করেছেন।
মিজানুর রহমানের বাবা মো. মুজিবুল হক সরকারি চাকরিজীবী। মিজান বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি, এইচএসসি পাস করেন। পরে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন।
মিজানুর রহমান জানান, ২০২০ সালে ইউটিউবে ড্রাগনে চাষ দেখে তিনি এ ফলের চাষবাদ করার উদ্যোগ নেন। পরে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে ড্রাগন চারা এনে রোপণ করেন। এরপর থেকেই প্রতিবছর ড্রাগনের চাষ করে আসছেন তিনি।
কাজু বাদাম চাষ
বগুড়ার শাহাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া গ্রামের মোহতাসিম বিল্লাহ রেজা কাজু বাদাম চাষ করে সাফল্যের মুখ দেখেছেন। ঢাকা কলেজ থেকে বিএসএস করে অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগসে কিছুদিন চাকরি করেছেন তিনি। তারপর চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকে ফিরে এসে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন। এরপর বাবার জমিতে শুরু করেন চাষাবাদ।
তিনি কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে ও সহযোগিতায় অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ৫০ শতক জমিতে ৮০টি কাজু বাদাম গাছ রোপণ করেন। এই চারা রোপণের পর স্থানীয়রা অনেকে তাকে বলেছেন এটা পাহাড়ের ফসল। এখানে হবে না। কিন্তু তিনি হতাশ না হয়ে, লোকের কথায় কান না দিয়ে ধৈর্য ধরে চারাগুলোর যত্ন নিয়েছেন।
শাজাহানপুর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আখতার রওজেয়ারা রোজী সব সময় তাকে সাহস ও সহযোগিতা করেছেন। ১৮ মাস পরে তার ৪০টি গাছে দেখা মিলেছে কাজু বাদামের।
মরুর ফল সাম্মান চাষ
বগুড়া সদরের মহিষবাথান গ্রামে সামিউল নামের একজন চাষ করেছেন মরু অঞ্চলের ফল সাম্মান। তার দেখে সাম্মান ফল চাষ করেছেন একই গ্রামের নুরুল ইসলাম এবং গাবতলী উপজেলার মধ্যকাতুলি গ্রামের কৃষক রাশেদুল মোর্শেদ।
আজোয়া খেজুর চাষ
নন্দীগ্রাম উপজেলার আমড়া গোহাইল গ্রামের আবু হানিফ বলেন, তিনি ২০১৯ সালে শখের বসে পরীক্ষামূলকভাবে ১৬টি সৌদি আরবের আজোয়া খেজুর গাছের চারা রোপণ করেন। সেখান থেকে ভালো ফল পেয়ে তিনি এখন আজোয়া খেজুরের বাগান করেছেন। তার দেখে শেরপুর এবং কাহালু উপজেলাতেও অনেকই আজোয়া খেজুর চাষ করছেন।
থাইল্যান্ড ও ভারতের ফল চাষ
বগুড়া সদরের কাজি নুরইল গ্রামের কৃষক আহসানুল কবির ডালিম চাষ করেন থাইল্যান্ডের পিংক পেয়ারা, টক বড়ই, ভারতের আম ভারত সুন্দরী ব্যানানা ম্যাংগো। তিনি বলেন, সঠিক পরিচর্যা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। স্থানীয় বাজারে এই বিদেশি ফলের চাহিদা রয়েছে। এই ফলগুলো সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।
কিং অব চাকাপাত আম
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মহিপুর বুড়িতলা পাড়া গ্রামের বৈশাখী নাসারির মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ২৫ বছর আগে রফিকুল ইসলাম শখের বসে নার্সারি ব্যবসায় নামেন। বর্তমানে ১৩ একর জায়গায় তিনি নার্সারি গড়ে তুলেছেন। তিনি চান নতুন কিছু চাষ করতে। নতুন কোনো জাতের সন্ধান পেলেই সংগ্রহ করতে ছুটে যান তিনি। জাত সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হন না তিনি, বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির গবেষক দলকে সঙ্গে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক গবেষণায় যুক্ত থেকে কাজ করেন সব সময়।
প্রশিক্ষণের পর, ২০১৭ সালে তিনি কিং অব চাকাপাত আমের চারা নিয়ে আসেন ঢাকার সাভারের একটি নার্সারি থেকে। প্রথমে ৪টি চারা নিয়ে আসেন। সেই চারাগুলো থেকে সায়ন সংগ্রহ করে গ্রাফটিং করে আরও চারা তৈরি করেন তিনি। সেই চারাগুলো গাছে পরিণত হয়, গাছ থেকে ক্রমান্বয়ে আমের মুকুল, ফল আসে। এর গুণগতমান পরীক্ষা করতে থাকেন তিনি।
রফিকুল জানান, ২-৩ বছর বয়সী একটি আম গাছ থেকে ৮-১০টি করে আম পান তিনি। এক-একটি আমের ওজন ১ কেজির মতো হয়। এরকম ১০টি গাছ থেকে তিনি ৮৬ কেজির মতো আম পান। আমের রঙ কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও আম পাকার আগে পুরোপুরি লাল বর্ণ ধারণ করে।
সূর্য ডিম, মিয়াজাকি, পালমার, কিউজাই প্রজাতির আমের চাষ
এদিকে বগুড়া পুলিশ লাইন্স মাঠে পতিত জমিতে সূর্য ডিম, মিয়াজাকি, পালমার, কিউজাই প্রজাতীর আম চাষ করেছেন বগুড়া পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। এছাড়াও তিনি তার অফিসের ছাদে বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির ফল চাষ করছেন।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে বগুড়ায় যোগদান করে পুলিশ লাইন্সের পতিত জমিতে বিদেশি জাতের আমের চারা রোপণ করেন। গত দুই বছর থেকে গাছগুলোতে আম ধরতে শুরু করেছে। এছাড়াও ছাদ বাগানে বিদেশি প্রজাতির অসংখ্য ফল গাছে ফল ধরতে শুরু করেছে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মতলুবুর রহমান বলেন, প্রতি বছরই বগুড়ায় বিদেশি ফল চাষ বাড়ছে। গত বছরের তুলনায় এবছর ৪৫ হেক্টর জমি বেড়েছে। জেলার ১২টি উপজেলায় এবছর এক হাজার ৮০৬ হেক্টর জমিতে ১৫ প্রজাতীর বিদেশি ফল চাষ করা হয়েছে।